Sunday, October 12, 2014

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প


 রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মf…মাগো…চেঁচিয়ে উঠলো সে।

পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।

তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো।
বুঝি সে-কারণে
ফরফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার শার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।

তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।

লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-

উর্বশী

– বিষ্ণু দে

আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
ক্ষনিকের মরালকায়
ইন্দ্রিয়ের হর্ষে, জান গড়ে তুলি আমার ভুবন?
এসো তুমি সে ভুবনে, কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে।
ক্ষণেক সেখানে থাকো,
তোমার দেহের হায় অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি
ঘুরি যে সময় নেই- শুধু তুমি থাকো ক্ষণকাল,
ক্ষণিকের আনন্দাঅলোয়
অন্ধকার আকাশসভায়
নগ্নতায় দীপ্ত তনু জ্বালিয়ে যাও
নৃত্যময় দীপ্ত দেয়ালিতে।
আর রাত্রি, রবে কি উর্বশী,
আকাশের নক্ষত্রাঅভায়, রজনীর শব্দহীনতায়
রাহুগ্রস্ত হয়ে রবে বহুবন্ধে পৃথিবীর নারী
পরশ-কম্পিত দেহ সলজ্জ উত্সুক?
আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
আমরণ আসঙ্গলোলুপ,
আমি জানি আকাশ-পৃথিবী
আমি জানি ইন্দ্রধনু প্রেম আমাদের।

ম’রে যেতে সাধ হয়


-আনিসুল হক

শাহানা,
তুমি গোলাপী জামা প’রে জীবন্ত
গোলাপের মতো
ক্যাম্পাসে এসো না, আমার
খারাপ লাগে।
সখী পরিবৃতা হয়ে মোগল-দুহিতার
মতো
করিডোরে অমন ক’রে হেঁটো না,
আমার খারাপ লাগে।

শাহানা, তুমি চিবুক নাড়িয়ে
রাঙা মাড়িতে
দুধ শাদা হাতে
লালিম জিহ্বায়
গিটারের তারের
মতো বেজে উঠো না —
দরদালান কেঁপে উঠে, ঢিল
পড়ে বুকের পুকুরে,
কাঁপে পানি থিরিথিরি, আমার
খারাপ লাগে।

শাহানা, তুমি টিফিন
আওয়ারে ক্লাসরুমে ব’সে
অমন করে রাধার মতো দীর্ঘ চুল
মেলে দিও না
অন্ধকার
করে আসে সারাটা আকাশ
নিবে যায় সবগুলি নিয়ন
কালো মেঘের
উপমা দিতে আমার
ভালো লাগে না।

শাহানা, তুমি ক্যাফেটেরিয়ায়
নিরেট চায়ের কাপে
ওই দুটি ঠোঁট রেখো না;
নিদাঘ খরার পোড়ে ঠোঁটের
বাগান,
মরুভূর মতো জ্বলে তৃষ্ণার্ত সবুজ;
আমার মরে যেতে সাধ হয়।

কবিতার মা ও তার ছেলেপুলে


 রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

শোনো কবিতার মা, তোমার ছেলেপুলে গুলো
ইদানিং ভীষন জ্বালাতন করছে আমায় ।

পড়ার টেবিলে এসে লাফায় এলোমেলো
কলম পেলেই তুলে নেয় হাতে – কি সাহস !
জানো তো সারাদিন কি রকম ব্যস্ত থাকি
রাতে একটু ভালো ঘুমের দরকার --

ছেলেপুলে গুলো কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে অসভ্য
ঘুমের ভেতরে বুকে সুড়সুড়ি কেটে
জাগায় আমাকে । আলো জ্বেলে দিয়ে
টেনে এনে বসায় টেবিলে । বলে লেখো

একেমন ফাজলামো বলো তো !
মগজের ভেতর দ্রিমদ্রিম পিটোচ্ছে বাদ্যযন্ত্র
তোমার ছেলেপেলে ছিলো কি বদমাস
না হয়েছে
ওদের বারন কোরে দিও । সাবধান
ফের যদি বিরক্ত করে, ওদের এক এক জনকে
আমি কিন্তু বেঁধে রেখে দেবো কাগজে
ছেলেপুলেদের সাবধান কোরে দিও !

চাঁদের ভিতর চাঁদ ভাঙে’


_____রুদ্র গোস্বামী
 

আমি চাই একটা চাঁদ উঠুক।
আমার কষ্টে খুব কাঁদুক।
আমার সুখে সে আলো আলো হাসুক।
তার তিলের মতো কলঙ্ক থাকুক,
সোনার মতো রূপ থাকুক।
তাকে দেখে আমি ভাবি
সব থেকে সুন্দর দৃশ্যটি বুঝি এই ।
আমার তাকে দেখতে ভালো লাগুক।
তাকে ছুঁয়ে আমি বলি,
সে আমার ভীষণ রকম সুখ।
আমি চাই একটা চাঁদ উঠুক
তার জন্ম শুধু আমার জন্যে থাকুক।
তার মৃত্যু শুধু আমার জন্যে থাকুক ।
তাকে পেয়ে আমি বলি,
তার জন্যে আমি এর আগেও বহুবার জন্মেছিলাম।
তার জন্যে আমার অপেক্ষা ছিল,অশ্রু ছিল।
অজস্র চিঠিতে তাকে আমি ভালবাসি লিখেছিলাম।
আমি চাই একটা চাঁদ উঠুক
তার কথা শুধু আমার জন্যে থাকুক,
তার ব্যথা শুধু আমার জন্যে থাকুক।
এমন তো নয় মেয়ে বলে কেউ চাঁদ ভাববে না ।
এমন তো নয় মেয়ে বলে কারো রূপ খুজতে নেই ।

"আমার চেয়ে আরোও ভালো মেয়ে পাবা"

"আমার চেয়ে আরোও ভালো মেয়ে পাবা"
বাক্যটি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে খুব সহজভাবে কানে এল রাতুলের।
"আমি রাখছি" বলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনের লাইন কেটে দিল রাতুল।
গত কয়েকদিন ধরেই মেয়েটার সাথে রাতুলের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া। তার উপর আজ আবার মেয়েটার এই রকম একটা বাজে চাওয়া।
মেজাজটাই বিগড়ে গেল রাতুলের। সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজের নালীটার বাতাসটাকে আবার দূষিত করতে করতে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল রাতুল।
এ কি শুনলো রাতুল? কার মুখ থেকে এ কথা বের হলো? যে মেয়েটি প্রতিদিন ভোরে ফোন দিয়ে জাগাত রাতুলকে, সে মেয়েটি?
যে মেয়েটি রাতুলের অসুস্থতার কথা শুনে নিজে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে রাতুলের খোঁজ নিত পাঁচ মিনিট পরপর, সে মেয়েটি?
যে মেয়েটি রাতুলের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য এটা ওটা কত কিছু করতে অনুরোধ করত, সে মেয়েটি?
যে মেয়েটি রাতুলের সমস্ত সুখ দুঃখের সঙ্গী হত, সে মেয়েটি?
যে মেয়েটি রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় ভয় পেয়ে রাতুলকে ফোন করতো ভয় কাটাবার জন্য, সেই মেয়েটি?
যে মেয়েটি সকালে ভার্সিটিতে পৌছে ফোন করে বলতো যে "পৌছে গেছি। তুমি নাশতা করে নাও", সেই মেয়েটি?
যে মেয়েটি রাতুলের....
মেয়েটিকে নিয়ে রাতুলের দেখা স্বপ্নগুলো আজ কেন জানি একটু অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। ফোনে ম্যাসেজের রিং বাজলো। মেয়েটিরই ম্যাসেজ। অতি আগ্রহ নিয়ে ওপেন করলো রাতুল।
"তোমাকে সবসময় যোগ্য আর প্রতিষ্ঠিত হতে বলি ভাল মেয়ে পাওয়ার জন্য। নজর এত নিচু কেন? বুয়েট পড়ুয়া মেয়েকে বৌ করবে। নৃবিজ্ঞান কোন বিষয় হল?"
ম্যাসেজটি পড়ার পর কি করবে ভেবে পাচ্ছে না রাতুল। যে মেয়েটিকে না দেখে ভালবাসতে শুরু করেছিল, যে মেয়েটিকে দেখার পর ভালবাসাটা আরোও তীব্র হয়েছিল, যে মেয়েটির জন্য রাতুল তার পঁচা লাইফস্টাইল চেইন্জ করে ফেলেছিল, আজ সেই মেয়েটিই তাকে....
অনেকটা অভিমানের সুরেই ম্যাসেজের রিপ্লাই করলো রাতুল, "কোনো কথা বলবে না, একদম চুপ।"
"আজ তো শুক্রবার, যাবে না বিকেলে পাংকু সাজ দিয়ে বাইরে?"
আবার ম্যাসেজ মেয়েটির।
এমনিতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে রাতুলের। তার উপর আবার মেয়েটির ফান! নিজেকে নিজের কাছেই কেমন জানি লাগছে রাতুলের।
"আমাকে মেরে ফেলতে পারবে?" রাতুল রিপ্লাই করলো।
জবাব এল, 'না, পারবো না'
ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিল রাতুল। পরক্ষণেই আবার ব্যাটারী আর খোলস তুলে নিয়ে আসলো। হয়ত এই ফোনটা দিয়েই আবার ইমুর মায়াভরা কণ্ঠটি শুনে নিজেকে সুখের সাগরে......